ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

রাত পোহালেই ঈদুল আজহা

নিজস্ব প্রতিবেদক ::

‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে পবিত্র হজ সম্পন্ন হল। ইসলামের পাঁচস্তম্ভের অন্যতম প্রধান এ স্তম্ভের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর এবার কোরবানির ঈদের পালা। রাত পোহালেই ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর সেই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ত্যাগের মাঝেই উৎসবে আমেজে সমৃদ্ধ এ ঈদ পালনে প্রস্তুত চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মুসলমানরা।
পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজেদের সঁপে দেয়াই এ ঈদের ইবাদত। ঈদের দিন সকালে নামাজ আদায়ের পরপরই পশু কোরবানির জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবেন মুসলমানরা। এরপর গরীবের মাঝে মাংস বিতরণের মধ্যদিয়ে কোরবানির মহান আদর্শ সবার মাঝে সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন বরাবরের মতো। ঈদের নামাজে ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলে এক কাতারে শামিল হয়ে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করবেন। ঈদুল আজহা একদিকে যেমন সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পন তেমনি অন্যদিকে কোরবানির মাংস বন্টনের মাধ্যমে ধনী গরীবের আত্মিক ও সমান্তরাল মিলনও। এছাড়া দরিদ্র আত্মীয় পরিজনের মাঝেও মাংস বিলিয়ে দেয়ার যে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা সেটার মাধ্যমেও সকলের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়।
আরবি শব্দ ‘কুরবাতুন’ বা ‘কুরবান’ থেকে কোরবানি শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ ত্যাগের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ। প্রতিবছর হিজরি সালের চান্দ্র মাসের ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে কোরবানির অফুরন্ত আনন্দ-সওগাত ও ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা নিয়ে উপস্থিত হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা পবিত্র ঈদুল আজহার কোরবানি পর্ব এবং অপরিহার্য এ ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রবর্তক। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সীমাহীন ভক্তি, সর্বোচ্চ ত্যাগের সদিচ্ছা ও গভীরতম আত্মসমর্পণে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ কোরবানি করার নির্দেশ প্রদান করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রিয়তম বস্তু তথা তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যা সর্বকালের মানব ইতিহাসে ত্যাগের সর্বোচ্চ নিদর্শন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কুদরত ও রহমতে শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হলো। এর মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ত্যাগের চরম পরীক্ষায় আল্লাহর দরবারে উত্তীর্ণ হয়ে যান। এরপর থেকে বিশ্বের মুসলমানদের জন্য জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে হালাল পশু কোরবানি করার রেওয়াজ চালু হয়।
এবার ডেঙ্গু রোগ মানুষের মাঝে কিছুটা শঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হলেও ঈদুল আযহাকে ঘিরে চারদিকে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা এবং উৎসবের আমেজের কমতি নেই। ঈদের দিন সকালে পশু কোরবানি দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে অধিকাংশ কোরবানিদাতা নিজেদের পছন্দের পশু কিনে ফেলেছেন। অনেকে আজ রোববার শেষমুহূর্তে পশু ক্রয় করবেন। কারন বাসায় রাখার ঝামেলা থেকে বাঁচতে অনেকে একেবারে শেষ মুহূর্তে কোরবানির পশু ক্রয় করেন।
এ ঈদকে ঘিরে শহর গ্রাম সবখানেই একই আমেজ। কোরবানির পশু কেনাকাটায় শেষমুহূর্তের তাড়াহুড়ো চলছে। চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করা অধিকাংশ মানুষ গ্রামে ছুটে গেছেন ঈদ করার জন্য। গ্রামে যারা ঈদ করবেন পশু কেনাকাটার কাজটি তারা সেখানেই সম্পন্ন করার জন্য ছুটেছেন আগেই। গ্রামের পানে ছুটে চলা মানুষের স্রোত গতকাল শনিবারও ছিল। একইসাথে বিশাল মানুষের ছুটে চলা যাত্রাপথে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে অনেককে।
এদিকে কোরবানির পশু কেনাকাটা সম্পন্ন করা কোরবানিদাতারা মাংস কাটার সময় ব্যবহৃত গুঁড়ি, দা, ছুরিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহে রয়েছেন। পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য কসাইয়ের খোঁজ নিয়েং রেখেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার কসাইয়ের কদর কিছুটা বেশি বলে জানালেন কয়েকজন।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অলি গলি এখন কোরবানির পশুতে ভরপুর। রাস্তার পাশে, বিল্ডিংয়ের নীচে রাখা হয়েছে বাজার থেকে কেনা কোরবানির গরু। বিশেষ করে ফ্ল্যাট বাড়ির নীচে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে কোরবানির গরু। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কোরবান উপলক্ষে এসব গরু কিনে রেখেছেন ফ্ল্যাট সংলগ্ন রাস্তায়।
এদিকে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত দিন পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনে মাঝখানে রয়েছে মাত্র একটি দিন। আজ রোববার রাত পোহালেই সোমবার মুসলমানরা মিলিত হবেন মহান ঈদ উৎসবে। যেখানে আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি থাকবে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ভাবগম্ভীর পরিবেশও।
মহান আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশে পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মুসলিম সমপ্রদায় তাদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। ঘরে ঘরে ত্যাগের আনন্দে মহিমান্বিত হবে মন প্রাণ। মসজিদে মসজিদে ঈদগাহে ঈদের নামাজের পর মুসল্লিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ মুনাজাত। এতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করবেন ইমামগণ।
কোরবানির মধ্য দিয়ে নিজের ভেতরের পশুত্বকে পরিহার করা এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) এর মহান আত্মত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কোরবানির দিনের শুরুতেই সবাই ঈদগাহে যাবেন ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করতে। নামাজ শেষে খুতবার পর আনন্দের দিনে অশ্রুসিক্ত হয়ে চিরকালের জন্য চলে যাওয়া স্বজনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর দরবারে কড়জোরে দোয়া করবেন ইমামগণ। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে নামাজ আদায়ের পর শুরু হবে ঈদের দিনের সবচেয়ে মনোরম পর্ব কোলাকুলি। ঈদের নামাজ শেষে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশে পশু কোরবানি এ ঈদের প্রধান কর্তব্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে সমস্ত লোভ, লালসা, ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা তথা ভেতরের পশুত্বকে ত্যাগের মধ্যদিয়ে আত্মশুদ্ধি লাভের মধ্যেই রয়েছে কোরবানের প্রকৃত তাৎপর্য। চিরন্তন এ তাৎপর্য বারবার ফিরে আসে মুসলমানদের দুয়ারে।
পবিত্র ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে চট্টগ্রামসহ দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক বাণীতে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আলহাজ আ জ ম নাছির উদ্দীন। এক শুভেচ্ছা বাণীতে সিটি মেয়র বলেন, পবিত্র ঈদ -উল -আযহা সুমহান ত্যাগের মহিমায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কোরবাণীর মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ত্যাগের মহান আদর্শ স্থাপিত হয়েছে, যা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পবিত্র ঈদুল আজহা ত্যাগের শিক্ষা ধারণ করে সমাজ গঠনে এগিয়ে আসার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান মেয়র। এছাড়া মহানগর বিএনপি সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনও নগরবাসীকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

পাঠকের মতামত: